Breaking

Thursday 7 January 2021

হাসন রাজার জীবনী

 

হাসন রাজা

হাসন রাজার পরিচয় ও  বংশ পরিচয়ঃ

হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালে ২১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটে সুরমা নদীর তীরে লক্ষণশ্রী পরগনায় তেঘরিয়া গ্রামে।তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী।হাসন ছিলেন তার ৩য় পুত্র।আলী রাজ তার খালাত ভাই আমির বখশ চৌধুরীর বিধবা নিঃসন্তান হুরমত জাহানকে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাসন রাজার জন্ম হয়।হাসন রাজার বৈমাত্রের ভাই উবাইদুর রেজার পরামর্শে তার পিতা তার নাম রাখেন অহিদুর রাজা। এটি ছিলো তার একটি ছদ্মনাম। একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। তার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ।দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।

হাসন রাজার বংশধররা ছিলো হিন্দু। তাদের একজন পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন।তার নাম বাবু চৌধুরী।হাসন রাজার পূর্বপুরুষরা ছিলো অয্যোধ্যায়।ষোড়শ শতকের শেষ দিকে তাদের একজন পূর্ব পুরুষ সিলেটে এসে বসতি স্থাপন করেন।

হাসন রাজার বাল্যকালঃ

 

তখন সিলেটে আবরী ফারসী ভাষার ব্যাপক চর্চা ছিলো হাসন রাজা নিজেও আরবী খুব ভালো জানতেন তার বহু দলিলে আরবীর স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো ।

হাসন রাজার সিংহাসন আরোহনঃ

  হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সব সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলী রাজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। অপরিপক্ব বয়সে এত সম্পদের মালিক হয়ে হাসন রাজা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগ-বিলাসী এক শৌখিন জমিদার।মাত্র ১৫ বছর বয়সে জমিদারি শুরু করেন হাসন রাজা। যৌবনে ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলেন। বর্ষায় বজরা নৌকা সাজিয়ে গান-বাজনায় ঘুরে বেড়াতেন। এ সময় একের পর এক গান লিখতে থাকেন। বিলাসী জীবনের মাঝে আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নেয় তার মনে। ছেড়ে দেন জমিদারি। বিলাসী পোশাক ছেড়ে নেন সাধারণ পোশাক। অত্যাচারী জমিদার থেকে হয়ে ওঠেন এক বাউল সাধক।।

 

 হাসন রাজার ভোগ -বিলাসীঃ

 

ভোগ- বিলাসীতে যৌবনে হাসন রাজা মত্ত ছিলো। তিনি রমনীর প্রতি ভোগান্তর ছিলেন।তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া।সে সময় হাসন রাজার ঘোরার পায়ের শব্দ শুনলে পুকুরঘাটের স্নানরত মেয়েরা ভয়ে পানিতে ডুব দিতো।হাসন রাজার চোখে পরলে তুলে নিয়ে যেতেন।
আবার নাইওরি নৌকায় হামলা করতেন। নৌকা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতেন। এতদিন হাসন রাজা পুকুরঘাটের পাশ দিয়ে আসার সময় গ্রামের আরেক মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের গলার মালা ছুড়ে দেন আর গেয়ে ওঠেনসোনা ’’বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল দেওয়ানা বানাইল  মোরে পাগল করিল”।আরেকবার পিয়ারীর প্রেমে পড়েছিলেন হাসন রাজা। পিয়ারী ছিলেন লখনৌ থেকে আসা একজন বাইজি। তিনিও খুব সুন্দরী ছিলেন। এই পিয়ারীর প্রেমে পড়ে হাসনগেয়েছিলেন ”নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল” রে হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন দিলারামকে। দিলারামও হাসন রাজাকেই তার সর্বস্ব মানতেন। দুজনের প্রেম ভালো জমেছিল। কিন্তু বাদ সাধেন হাসন রাজার মা। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তার মা দিলারামকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেন। কিন্তু দিলারাম বলেছিলেন আমি চলে গেলে অঘটন ঘটে যাবে মা  এবং এর পরপরই হাসন রাজা বাইজিবাড়ি আর শরাবে ডুবে থাকতেন।

হাসন রাজার বৈরাগ্যের সূচনাঃ

 

হাসন রাজার বৈরাগ্যের সম্পর্কে তিনটি চিরাচরিত কথা উল্লেখ আছে।এই কথাগুলো লোক কথা।
হাসন রাজা নাইওরি নৌকায় হামলা করতেন। নৌকা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতেন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হাসন রাজার মা   নাইওরি নৌকায় নিজেকে তার শিকার হিসেবে উপস্থাপন করেন। হাসন রাজা যখন দেখলেন তার নিজের মা-কে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন তখন লজ্জা পেয়ে হাসন রাজা এ পথ থেকে ফিরে আসেন।  হাসন ক্ষমা চেয়ে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। এর পরই তার মধ্যে বৈরাগ্যের সূচনা হয়েছিল। আবার অনেকের মতে, ঘটনাটি এরকম যে হাসন রাজা পশু-পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। ঘোড়াও পুষতেন হাসন। তার প্রিয় দুটি ঘোড়ার একটি হলো জং বাহাদুর, আরেকটি চান্দমুশকি। এরকম আরও ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া গেছে ইতিহাসবিদদের মতে। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপার টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন। পশু-পাখির যত্ন ও লালন-পালনের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন আসাম এবং সিলেট এলাকায় ৮.৮ রিখটার স্কেলের এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মানুষসহ অনেক পশু-পাখি প্রাণ হারায়। পরে এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে হাসন রাজা দেখলেন তার অনেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাসনের অনেক পশু-পাখির মৃত্যু হয়েছে। এরপর তার মনে জীবন সম্পর্কে কঠিন বৈরাগ্যের সূচনা করে। হাসন রাজার প্রথম জীবনের কালো অধ্যায়ের ইতি ঘটে। আবার অনেকে বলে থাকেন একদিন হাসন রাজা একটি আধ্যাত্মিক স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন। তবে যেভাবেই পরিবর্তন ঘটুক না কেন এরপর থেকে হাসন রাজা নিয়মিত প্রজাদের খোঁজখবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে চলতে লাগল গান রচনা। তার অন্তর্জগতেও বিরাট পরিবর্তন আসে। অত্যাচারী জমিদার থেকে বনে গেলেন বাউল সাধক। সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নেওয়া হয়ে উঠল তার প্রতিদিনের কাজ। সেই সঙ্গে চলতে থাকে গান রচনা।।

হাসন রাজার গানের সংকলনঃ

হাসন রাজার ২০৬ টি গান নিয়ে ১৯০৭ সালে “হাসন উদাস” নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। 

 
এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিন পুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

তাছাড়া সিলেটের লোকরে মুখ থেকে বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে গান।এই পর্যন্ত হাসন রাজার ৫৩৫ টি গান পাওয়া যায় আবার অনেকে মনে করেন ১০০০ বেশী গান রয়েছে হাসন রাজার। হাসন রাজার গানের উল্লেখযোগ্য কিছু লাইনঃ


গুড্ডি উড়াইল মোরে,মৌলার হাতের ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।।
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।।

 

 

যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি।
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে।।
সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।
কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে।।
করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী।
করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে।।
(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া।
করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে।।
ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা।
প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।

 

 

আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।

 

 

ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।।

 

হাসন রাজার গানে কিছু আঞ্চলিক শব্দঃ

 

*আক্কল *জিয়ন
  • ভালা
  • ঠেকাইলায়
  • মুঞ্জিয়া
  • গানা
  • বেসক
  • বাড়ৈ
  • খেইড়
  • বন্ধে
  • লাঙ্গ
  • নাতিন
  • বুচা
  • লেইনজ
  • আজল
  • হাড়ুয়া পোক
  • মাড়ইল
  • গুড্ডি
  • ডুরি
  • হাউস
  • রেকি
  • উন্দা কল
  • মুস্করিয়া
  • টাটি
  • ছঙ্গাসন
  • খেওয়ানী
  • টন্‌কাইলে
  • আঞ্জা
  • খুবী
  • খেশ
  • ঢেন্ডুরা
  • ঠমকাইয়া
  • নাছন
  • গছে
  • ফাল্‌
  • পুতলা
  • ভৈসাল* জুংরা
  • সামাইল
  • লাইন্তি
  • চিনিবায়
  • কহন
  • বিকে
  • চিড়াবারা
  • কারাকারা
  • তারাবারচ* আঙ্গে আর ডাঙ্গে
  • আন্ধাইর গুন্ধাইর

 

রবীন্দ্রনাথের চোখে হাসন রাজাঃ

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাছন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তার দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি 'Modern Review' ( January 1926 ) পত্রিকায় 'The philosophy of Our People' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' ( মাঘ ১৩২২ ) পত্রিকায়। ভাষণে হাছন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলো :
"পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির [হাছন রাজা] গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-

এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।

১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'হিবার্ট লেকচারে' রবীন্দ্রনাথ 'The Religion of Man' নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাছন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।।(তথ্য সূত্রঃ.wikipedia.)
 
 
হাসন রাজার জাদুঘর

হাসন রাজার জাদুঘরঃ
 
 
হাসন রাজার জাদুঘর সিলেটে জিন্দাবাজারে অবস্থিত।বর্তমান হাসন রাজার বাসভবন জাদুঘর হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই জাদুঘর থেকে লোক সংস্কৃতি দিক উঠে আসে। হাসন রাজাকে কেন্দ্র করেই সাজানো হয়েছে পুরো জাদুঘরটি। রাজাকুঞ্জ হচ্ছে শতবর্ষী পুরাতন টিনশেডের দালান যাতে অল্প কয়েকটি কক্ষ আছে। প্রধান ফটকের কয়েক মিটার পরেই জাদুঘরের অবস্থান। দর্শনার্থীদের প্রবেশপথে হাসন রাজা এবং তার পুত্র একলিমুর রাজা চৌধুরীর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে দুটি গ্যালারি আছে। প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক দর্শনার্থী জাদুঘরটিতে আসেন। এর বাইরে শুক্র ও শনিবার সিলেটে যখন পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে তখন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী হাসন রাজার সৃষ্টি ও জীবনকে জানতে জাদুঘরে আসেন। জাদুঘরে প্রাচীন বইপুস্তক ও হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী রয়েছে।
 
 
 
হাসন রাজা ১৯২২ সালে মৃত্যুবরন করেন। সুনামগঞ্জে একটি এলাকাধীন কবরস্থানে তাকে সমাধি দেয় হয়।

 

 

 

 

 



 




 

No comments:

Post a Comment