Breaking

Friday, 21 August 2020

পথের পাঁচালী

পথের পাচালী - বিভূতিভূষণ ...
পথের পাচালী

লেখক- পরিচিতি::::


বিভূতিভষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের  ২৪ পরগনা জেলায় তার মাতুলালয় কাঁচড়াপাড়ায় সমীপবর্তী ঘোষ পাড়া -মুরাতিপুর গ্রামে।তার পিতৃনিবাস একই জেলার ব্যারাকপুর।জন্ম তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ ইং মোতাবেক ২৮ ভাদ্র ১৩০১ বাংলা।তার পিতার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্ররী পেশা ছিল কথকতা; মাতা মৃণালিনী দেবী।বিভূতিভূষণের বাল্য ও কৈশোরকাল কাটে অত্যন্ত দারিদ্র্যে।কারণ মহানন্দ কিছু পরিমাণে ভবঘুরে ও উদাসীন প্রকৃতির লোক ছিলেন বলে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করতে পারেননি-অর্জন করার চেস্টাও বোধ হয় করেননি।পিতামাতার পাঁচটি সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই সর্বজ্যেষ্ঠ।তার শিক্ষা শুরু হয় গৃহে পিতার নিকট।কিন্তু তিনি  ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র।যখন তিনি অষ্টম শ্রেনির ছাত্র,সেই সময়ে তার পিতা মারা যায়।নানা দুঃখ কষ্টের মধ্যে তিনি ১৯১৪ সালে ম্যট্রিক পাশ করেন।১৯১৬ সালে তিনি কলিকাতার রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ.পাস করেন এবং১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ঐ কলেজ থেকেই ডিসটিংশনে বি.এ পাস করেন। এর পর তিনি এম .এ ও ল ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন,কিন্তু  লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বসিরহাটের মোক্তার কারীভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় কণ্যা  গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন।কিন্তু এর মাত্র এক বছর পরেই গৌরি দেবীর অকালমৃত্যু ঘটে।স্ত্রী মৃত্যুর পর কিছুদিন তিনি প্রায় সন্ন্যসীর জীবন যাপন করেন। এরপর তিনি রমা দেবীকে বিবাহ করেন।বিবাহের সাত বছর পরে তার একমাত্র তারাদাস জন্মগ্রহণ করে।তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়ায় মাইনর স্কুলে শিক্ষকের চাকুরি গ্রহণ করেন এবং তারপর ২৪ পরগনায় হরিনাভি গ্রামের উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এখানে তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়।এখানে তার সাহিত্যি জীবন শুরু হয়।তার প্রথম রচনা “উপেক্ষিতা”নামক গল্প। তিনি চাকুরির কারনে  বাংলা,আসাম,ত্রিপুরা ও আরাকানের বহুস্থানে ভ্রমণ 
করেন।এরপর তিনি জমিদার ভাগলপুর বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হয়ে ঐ শহরের “বড় বাসা” নামক গৃহে অবস্থান করেন। এই ভাগলপুর প্রবাসকালেই তার অমর উপন্যাস “পথের পাচালী” রচিত হয়। এর পর তিনি ঘাটশিলায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন এবং  প্রথম স্ত্রী স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে তার নামকরণ করে ‘গৌরীকুঞ্জ”।তিনি ভ্রমণ করেতে অনেক ভালোবাসতেন। ‘গোরক্ষনী ” সভার ভ্রাম্যমাণ প্রচারকরুপে তিনি যে অভিক্ষতা অর্জন করেছিলেন তা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তার ‘অভিযাত্রিক’ গ্রন্থে।

জীবনে শেষ দশ বছর বিভূতিভূষণ  বন্দ্যোপাধ্যায় তার অতি প্রিয় পিতৃভূমি ব্যারাকপুরে বাস করেছিলেন।এই সময়ে তিনি অজস্র শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তিনি অনেক উপন্যাস ও ছোট গল্প রচনা করেন।জীবনের প্রায় শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সাহিত্য -সাধনায় ব্রতী ছিলেন। ১৯৫০ সালে ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে ঘাটশিলায় স্বগৃহে রাত ৮.১৫ মিনিটে সময় তিনি পরলোকগমন করেন।
 
 
#বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা সমূহ:::::::::::::

উপন্যাস::::::: 
*পথের পাঁচালী(১৯২৯)

*অপরাজিত(১৯৩২)

*দৃষ্টি-প্রদীপ(১৯৩৫)

*আরণ্যক(১৯৩৯)

*আদর্শ হিন্দু হোটেল(১৯৪০)

*বিপিনের সংসার(১৯৪১)

*দুই বাড়ি(১৯৪১)

*অনুবর্তন(১৯৪২)

*দেবযান(১৯৪৪)

*কেদার রাজা(১৯৪১)

*অথৈ জল(১৯৪৭)

*ইছামতি(১৯৫০)

*দম্পতি(১৯৫২) 

গল্প-সংকলন::::::::::
*মেঘমল্লার(১৯৩২)

*মৌরী ফুল(১৯৩২)

*যাত্রাবদল(১৯৩৪)

*জন্ম ও মৃত্যু(১৯৩৮)

*কিন্নরদল(১৯৩৮)

*বেনীগির ফুলবাড়ি(১৯৪১)



*নবাগত(১৯৪৪)

*তাল-নবমী(১৯৪৪)

*উপলখন্ড(১৯৪৫)

*বিধু মাষ্টার(১৯৪৪)

*ক্ষণভুঙ্গর(১৯৪৫)

*অসাধারণ(১৯৪৬)



*মুখোশ ও মুখশ্রী(১৯৪৭)

*আচার্য কৃপালনী কলোনী (১৯৪৮)

*জ্যোতিরিঙ্গণ(১৯৪৯)

* কুশল পাহাড়ি(১৯৫০)

*রূপহলুদ(১৯৫৭)

*অনুসন্ধান (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ)

*ছায়াছবি(১৩৬৬ বঙ্গাব্দ)

*সুলোচনা(১৯৬৩)

*ভ্রমনকাহিন ও নিনরিপি::::::::::::
*অভিযাত্রিক(১৯৪২)

*স্মৃতির রেখা(১৯৪১)

*তৃণাঙ্কর(১৯৪৩)

*উর্মিমুখর(১৯৪৪)

*বনে-পাহাড়ে(১৯৪৫)

*উৎকর্ন(১৯৪৬)

*হে অরণ্য কথা কও(১৯৪৮)

*কিশোর পাঠ্য:::::::::::::
*চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮)

*আইভ্যানহো(১৯৩৮)

*মরণের ডঙ্কা বজে (১৯৫০)

*মিসমিদের কবচ(১৯৪২)

*হীরা মানিক জ্বলে(১৯৪৬)

*সুন্দরবনের সাত বৎসর (১৯৫২)

*বিবিধ::::::::::::::

*বিচিত্র জগত(১৯৩৭)

*টমাস বাটার আত্মজীবনী(১৯৪৩)

*আমার লেখা (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮)

*দৃষ্টি প্রদীপ উপন্যাসটির চরিত্র সূমহ:::::::::::
গল্পটির মূল চরিত্র হল জিতু আর তিন ভাই বোনের সমাহার

*জ্যাঠামশায়-হরিবল্লভ

*জ্যাঠাইমা

*নিতাই

*জিতু

*সীতা

*ভূবন

*ভূবনের মা

*মেজো কাকি

*ছোটকাকিমা-নির্মলা

*হীরাঠাকুর

*সলিলদার

*শীতলদা

*মালতী

*হিরণ্ময়ী

*নবীন চৌধুরী

*শৈলদি

*শ্ররামপুরে ছোট-বৌঠাকুরান 



সারসংক্ষেপ

পথের পাঁচালী’ প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা একটি বিখ্যাত সামাজিক বাস্তব উপন্যাস। লেখকের স্বচ্ছ -সাবলীল ভাষায় আমাদের সমাজের বাস্তব ও জীবন্ত ছবিটিরই একটি সহজ-স্বাভাবিক রূপ তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে।আমরা, থার্ড জেনারেশান, কখনও কী ভেবেছি যে একজন নারীর কিরকম অনুভূতি হয় যখন সে ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত, অবহেলিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হয়, কারণ তার কোন আয়ের উৎস নেই, ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, গঠনগত দূর্বলতার কার ।যখন কোন নারী অল্পবয়সে স্বামী হারা হয় এবং সমাজ তাকে আবার বিয়ে করবার অনুমতি দেয় না, তখন সেই নারীর সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর অত্যান্ত নিখুঁতভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” উপন্যাসে রয়েছে।

এই উপন্যাসের প্রথম দিকে আমরা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি বাল্যবিবাহ ও যৌতুককে দানবীয় আকার ধারণ করতে দেখি। ইন্দির ঠাকুরনের বিয়ে অল্পবয়সে এমনই এক লোকের সাথে লোকের সাথে দেয়া হয়, যে বেশি যৌতুকের লোভে অন্যত্র বিয়ে করেন এবং আর কখনও ফিরে আসে না। তখন আয়হীন ইন্দির ঠাকুরনের আবাসস্থল হয় তার পিতার বাড়িতে, এবং তাদের ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হরিহরের বাড়িই তার স্থান হয়।সেখানে প্রতিমুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেয়া হত যে সে একজন আশ্রিতা, করুণার পাত্রী ছাড়া আর কেউ নয়। সে প্রায়শই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, কিন্তু দিন শেষে তার পথ এসে শেষ হত হরিহরের বাড়িতেই। একবার ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে তাকে একেবারে বের করে দেয়া হয় এবং মর্মান্তিকভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে। মৃত্যু হয় অসহায়ত্বেরর। 

এই উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ ‘আম আঁটির ভেঁপু’-এ অত্যন্ত সুচারুভাবে হরিহরের সন্তানদ্বয়- বড়মেয়ে দূর্গা ও ছোট ছেলে অপুর টক-মিষ্টি সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।

দূর্গা একপর্যায়ে অপুকে মারে, কারণ সে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চুরি করে আম খাওয়ার ঘটনা বলে দেয়। এই কারণে তাকে প্রতিবেশীর কথাও শুনতে হয়। রাগের মাথায় দুর্গার মা সর্বজায়া ওকে বকাবকি করেন। উপন্যাসের এক পর্যায়ে ম্যালেরিয়া জ্বরের শেষ পর্যায়ে এসে দুর্গা মারা যায়।

উপন্যাসের শেষ অংশ ‘অক্রুর সংবাদে’ চিরাচরিত বাংলার বড়লোক-গরীবের বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
লেখক সাফল্যের সাথে দেখিয়েছেন, যে একজন ব্রাক্ষ্মণ নারীর(সর্বজয়া) কি অবস্থা হয়, যখন অর্থের জন্য তাকে কাজের লোকের কাজ করতে হয়। দুর্গার মৃত্যুর পর তারা গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে এক পর্যায়ে জ্বরে স্বামী হরিহরও মারা যায়। তার চোখের অশ্রু মোছার জন্যও কেউ ছিল না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়। সাহায্যের হাত কেউ বাড়ায় না।

অবশেষে সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলে অপুকে নিয়ে তার নিজ গ্রাম নিশ্চিন্দি পুরের পথে রওনা হয়। কিন্তু সে তার সঠিক পথ খুঁজে পায় না।

কিন্তু বলাই বাহুল্য যে এই সামাজিক বৈষম্য আজকের একবিংশ শতাব্দিতে এই উন্নত সমাজেও পরিলক্ষিত হয় ।

মূলভাবঃ( সুনির্মল গুপ্ত বুলবুল লেখা)

বাংলা সাহিত্যে গ্রামীণ পটভূমিকায় যে বরেণ্য কথাশিল্পী সফল কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়। এই অসাধারণ কথাশিল্পী ১৮৯৪ খ্রিঃ ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায় কাঁচড়াপাড়া হলিশহরের কাছে মুরাতিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় মাতা মৃণালিনী দেবী।

বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) জন্ম না হলে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের মুক্তি নিশ্চিতভাবেই আর কিছুকাল বিলম্ব হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা কথা শিল্পের যে ঘরানা তৈরি করেছিলেন সেই আবর্তন থেকে বাইরে আসার জন্য কয়েকজন প্রধান কথাকারের প্রয়োজন হয়, বিভূতি ভূষণ তারই একজন।

১৯২৯ খ্রিঃ প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী লেখেই যিনি খ্যাতির উঁচু শিখরে উঠেছিলেন। সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকরা যখন অনেকে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহে শামিল হয়ে গিয়েছিলেন তখন বিভূতি ভূষণ রবীন্দ্রনাথের পথ ধরেই সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ‘পথের পাঁচলী’ তার প্রথম উপন্যাস এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এরপর তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আর কোন উপন্যাসই তার প্রথম গ্রন্থের সিদ্ধিকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। গ্রন্থাকারের ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিঃ এবং অপরাজিত প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিঃ। গ্রন্থ দুটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও সমালোচক বুঝতে পারেন যে ‘বাংলা উপন্যাসের মহাকাব্যে নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়েছে’ মূলত ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশের পর বিভূতি ভূষণ পাঠকের হৃদয়ে একটি স্থান দখল করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, ঘর-বাইরে, যোগাযোগ এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনা পাওনা ইত্যাদি তখন বেরিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্র কারও দ্বারাই তিনি প্রভাবিত হননি।

বিভূতি ভূষণ বাংলা সাহিত্যে স্নিগ্ধ প্রকৃতির নিঃসঙ্গ উপাসক। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও জীবন, তার আকাশ বাতাস, রৌদ্র বৃষ্টি, গাছপালা, নদী-মাঠ সবকিছুই তার সত্তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আর সাহিত্যে তিনি প্রকৃতিরই এক স্নিগ্ধ কোমল, সৌন্দর্যময় রূপ উপস্থিত করেছিলেন।

বিভূতি ভূষণের পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে সূক্ষ্ম তুলিতে এঁকেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিভূতি ভূষণের অমিল এই যে, বিভূতি ভূষণ প্রকৃতির রুদ্র কঠোর রূপের আরাধনা করেননি। তার শান্ত স্নিগ্ধ মমতাময় দিকটিকেই মানব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব প্রকৃতির সৌন্দর্য সমারোহেই মুগ্ধ হয়েছিলেন, অথচ শুধু বিশ্ব প্রকৃতির নয়- গ্রাম বাংলার নিতান্ত তুচ্ছ জিনিসটিও বিভূতি ভূষণের মন কেড়ে নিয়েছিল। বাংলার ধুলামাটির এমন মমতা ভরা রূপচিত্র আর কোন ঔপন্যাসিক আঁকেননি।

তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির রূপকে দেখেছেন খ-খ-ভাবে। আর বিভূতি ভূষণ প্রকৃতির সমগ্র রূপের একটা সত্তাকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

সাহিত্যিক হিসেবে বিভূতি ভূষণের বন্দোপাধ্যায় প্রধানত ঔপন্যাসিক। ছোটগল্পকার হিসেবেও তার খ্যাতি বিন্দুমাত্র কম নয়। তার কিছু গল্পে ঐতিহাসিক রোমাঞ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, কিছু গল্পে অনৈসর্গিক প্রেরণা কাজ করেছে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই লেখকের রোমান্টিক অনুভব মানবিক ভাবাবেগ ও প্রকৃতি বর্ণনায় শিল্প সার্থক হয়ে উঠেছে, তবে কিছু রচনায় পরিবারকে কেন্দ্র করেই তিনি তার সহানুভূতি স্নিগ্ধ ছোট গল্পগুলো রচনা করেছেন।

বিভূতি ভূষণ আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার বিরোধী। নিষ্ঠুর ধনীদের পক্ষপাতী নন। তিনি দরিদ্র সংসারকেই প্রেম ও ভালবাসার প্রতিষ্ঠাভূমি বলে বিশ্বাস করতেন।

বিভূতি ভূষণের লেখায় গ্রাম বাংলার দুঃখ, দারিদ্র্য, স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা পরিস্ফুটন হয়ে উঠেছে। বিচিত্র জীবনপ্রবাহের ধারা থেকে বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় সঞ্চয় করেছিলেন অপূর্ব অনুভূতি। জীবন আর শিল্প তো স্বতন্ত্র কিছু হতে পারে না। পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি আর জান্তব জীবনচর্চার সঙ্গে নিবিড় সাহচর্য থেকে শিল্পীসত্তা রসদ ও রস গ্রহণ করেন। আর তার মিলন মিশ্রণে গড়ে তোলেন শিল্প, যার নাম জীবনশিল্প।

কারও কারও ক্ষেত্রে অন্তর্জীবন বলে একটা স্বতন্ত্র বস্তুভাবনা দেখি। আর এই ভাবনায় শেষ পর্যন্ত জীবন দর্শন বলে প্রচারও করেন তারা- অথচ ব্যক্তিগত জীবন তাদের খুব সাধারণ মানুষের মতোই। অনেকটা বৈচিত্র্যহীন, নিরামিষ মন্থিত জীবনরস। তাই তাদের রচনায় আমরা তা পাই না। কেননা সাদামাটা জীবন থেকে রস নিংড়ে বের করা অনেক সময়ই অর্থহীন শ্রমে পরিণত হয়। কিন্তু বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় একজন খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর মতো হয়েও জীবনকে গভীর উপলব্ধি দিয়ে দেখেছেন, দেখতে চেয়েছেন ও পেয়েছেন নানা কৌণিক আলো ফেলে, আর এই আলো তাঁর মন্থিত জীবন থেকে উৎসারিত।

বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারা শঙ্কর, বিভূতি ভূষণ প্রায় এক নিশ্বাসে উচ্চারিত নাম। এদের মধ্যে বিভূতি ভূষণ ব্যতিক্রম এবং বলব সৌভাগ্যবান এ কারণে যে, প্রথম উপন্যাসই তিনি শ্রেষ্ঠতম অর্জনটুকু অধিকার করেছিলেন। অবশ্য তার জনপ্রিয়তার পেছনে তথা পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রায়ন রূপে পরিস্ফুটন যার প্রাপ্যতা তিনি বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এ বিষয়ে সুচিন্তিত আলোচনা আমরা প্রবন্ধের শেষ ভাগে তুলে ধরছি।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘এর থেকে শিক্ষা কিছুই হয়নি, দেখা হয়েছে অনেক- যা পূর্বে এমন করে দেখিনি’। রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিতে এই যে অন্তর্দৃষ্টি এবং পঞ্চইন্দ্রিয় সমন্বয়ে দেখা, সে প্রকাশ তা বিভূতি ভূষণের জন্য অ-নে-ক বড় প্রাপ্তি। পরিচিত পরিবেশকে নতুন করে দেখা ও দেখানোর আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়।

‘পথের পাঁচালী’ মুখ্যত শিশু অপুর বড় হয়ে ওঠার কাহিনী, যে পথ দিয়ে জীবনে সে অগ্রসর হয়েছে। যে সব মানুষের সংস্পর্শে সে এসেছে, তা সেই কাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ এর পটভূমি সুবিস্তৃত। পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরুরায়ের উপখ্যান যদিও দূর ইতিহাসে অঙ্গীভূত, কৌলীণ্য প্রথার অমানবিক যন্ত্রে পিষ্ট ইন্দিরা ঠাকুরনের জীবন ইতিহাস অত সুদূরের নয়। ইন্দিরা ঠাকুরনের প্রতি সর্বজয়ার আচরণ সব সময় মানবিক নয়। যে মা দুর্গা ও অপুর জীবনের উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত। পিসির প্রতি তার মায়ের রূঢ় ব্যবহার তাদের জীবনে প্রাথমিক অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। উপন্যাসের পরবর্তী অংশ অপু-দুর্গার শৈশব কাহিনীÑ সে কাহিনী অভিনবত্বে অসাধারণ নয়, কিন্তু মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তারা দুজনেই গ্রাম্য প্রকৃতিকে ভালবাসে। নতুন নতুন অভিযানে দুর্গা অপুর পথপ্রদর্শক, তবে অপুর মধ্যে অনুভূতির যে প্রখরতা এবং ভাবুকতার যে দোলা লক্ষ্য করা যায়, দুর্গার মধ্যে আমরা তা দেখি না। দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনে বড় রকমের আঘাত হানে, তার অভ্যস্ততায় ছেদ টানে, কিন্তু তা অপুর স্বাধীন বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার পথও উন্মুক্ত করে দেয়।

পথের পাঁচালী উপন্যাসে ‘প্রাণ’ অপু, অপুকে কেন্দ্র করেই এ উপন্যাসের কাহিনী যেমন আবর্তিত হয়েছে, তেমনি অপরাজিত উপন্যাসের কাহিনীও আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অপুর শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসদ্বয়ে, পথের পাঁচালী প্রকাশিত হলে নীরদ সি. চৌধুরী একে ইড়ঃধহরপধষ ঘড়াবষ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

এই উপন্যাসে অপু প্রকৃতি পুত্র; দুর্গাকে বলতে হয় প্রকৃতি কন্যা কারণ দুর্গাও প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট হয়েছিল। নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অপুর তাই মনে হয়েছে যে দুর্গা মারা গেলেও দুজনের খেলা করার পথেঘাটে বাঁশবনে, আমতলায় যে তার দিদি দুর্গাকে যেন এতদিনে কাছে কাছেই পেয়েছে। অপুর এই অনুভবই প্রমাণ করে দুর্গার প্রকৃতিশীলতা তবে দুর্গা নিজে প্রকৃতিপ্রেমী ছিল না, প্রকৃতি তার অনুষঙ্গী মাত্র।

বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় যে দুর্গাকে শেষ পর্যন্ত ‘পথের পাঁচালী’র প্রাণপ্রতিমা করে নিয়েছিলেন তাকে বিসর্জন দিতে গেলে কিছুটা মানসিক সান্ত¡নার প্রয়োজন হবেই। সান্ত¡নার সেই আন্তরিক অভিব্যক্তি মৃত্যুর শিল্পিত ব্যঞ্জনা হিসেবে অমর হয়ে থাকবে। বিভূতি ভূষণ লিখেছেনÑ ‘আকাশে নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসেÑ পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলেÑ পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূর পারে কোন পথহীন পথে দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা বড় অজানার ডাক আসিয়া পৌঁছিয়াছে’ সাহিত্যে শিল্প বা শিল্পীর মৃত্যুর উপমা হিসেবে লেখক দুর্গার শিল্পিত মৃত্যু যেভাবে ব্যক্ত করেছেন তা নিঃসন্দেহে অপূর্ব।

পৃথিবীখ্যাত বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) ১৯৫৪ খ্রিঃ ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্র রূপায়ণে প্রস্তুতি নেন। ১৯৫৫ খ্রিঃ প্রেক্ষাগ্রহে প্রথম প্রদর্শিত হয় ‘পথের পাঁচালী’। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে প্রথম ছবি। উল্লেখ প্রয়োজন যে, সত্যজিৎ রায় ১৯৪৩ খ্রিঃ ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম চিত্রনাট্য রূপ প্রকাশ করেন। ১৯৫৬ খিঃ কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। পথের পাঁচালী শিল্প প্রকরণের কেন্দ্রবিন্দু ‘প্রকৃতি’ উপন্যাসটির আপাদমস্তক যে স্নায়ুর তন্তুকে বয়ন করা হয়েছে তা প্রকৃতিজাত। এই শিল্পপ্রকরণ সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রে যেভাবে পরিস্ফুটন করেছেন তা নিঃসন্দেহে অসাধারণ।

বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসে গ্রামবাংলার দুঃখ দরিদ্র বাঙালী পরিবারে আজন্ম বাস্তব খুঁটিনাটি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সত্যজিৎ রায় তার মেধা ও মননের ধ্যানে তৎকালীন সময়ে পুরো একটি গ্রামকে মডেল হিসেবে চলচ্চিত্র রূপায়ণ করেন। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে ‘পথের পাঁচালী’ সুনাম অর্জন করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় ১৯৫০ খ্রিঃ পরলোক গমন করেন তাই ১৯৫৫ খ্রিঃ কালজয়ী উপন্যাসটি চলচ্চিত্র শিল্পরূপ স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি।

পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ১৯৫১ খ্রিঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ অর্জন করে, খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ গ্রন্থের ব্যাপারে বলেন যে, ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি ছবির চাইতে বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সত্যজিৎ রায় একজন বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রকার এবং খ্যাতির জন্য তথা পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করার ফলে সারা পৃথিবী জানতে পারে একজন বিভূতি ভূষণ ও সত্যজিৎ রায়কে, সুতরাং ‘পথের পাঁচালী’ গ্রন্থকে মূল্যায়ন করা তাঁর মহানুভবতা স্পষ্টত প্রকাশ পায়। বই বা উপন্যাস পড়ে আমরা কল্পনা জগতে চলে যাই। যার স্থায়িত্ব অনেকাংশে কম উপরন্তু কোন উপন্যাস চলচ্চিত্র রূপায়ণ করলে চরিত্রগুলো জীবন্ত মনে হয় যেমনটি পথের পাঁচালীর দুর্গা ও অপুর শৈশব কাহিনী চলচ্চিত্রে যেভাবে পরিস্ফুটন হয়েছে তা অসাধারণ। চলচ্চিত্রায়নে আপাতত দুটো দৃশ্য অবতারণা করছি।গ্রামের এক পাশে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেদ করে রেললাইনের ওপর ছুটে যাওয়া বাষ্পীয় ইঞ্জিন পরিচালিত রেলগাড়ি, যার ঝিকিঝিকি শব্দ। দু’ভাইবোন মিলে নদীর পারে কাঁশবন দু’হাতে সরিয়ে রেল দেখার আনন্দ যেন এক রহস্য জগতের বার্তা পৌঁছে দেয়। এই অনুপম দৃশ্যটি সত্যজিৎ রায় শিল্পরূপ আলাদা মাত্রা যোগ করে দেয়।

দুর্গার মৃত্যুর পর অপু সারাক্ষণ দিদির কথা ভাবত। দুর্গার ওপর যে চুরির অভিযোগ ওঠে সেই চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য অপু পুকুর পাড়ে গিয়ে সেই স্বর্ণের লকেটটা জোরে একেবারে মাঝ পুকুরে ফেলে দেয় তৎক্ষণাৎ দ্রব্যটি বুদবুদ করে নিচে তলিয়ে যায় অপু দাঁড়িয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ পর জলের মধ্যে সৃষ্ট তরঙ্গ মিলে গেছে। অপু নিশ্চিত হয় যে আর কোনদিন দিদির ওপর চুরির প্রমাণটা কেউ খুঁজে পাবে না।

এই আবেগপ্রবণ ও মর্মস্পর্শী দৃশ্য স্যালুলয়েডের ফিতায় বন্দী করেন সত্যজিৎ রায়। এ রকম অনেক খুঁটিনাটি শৈল্পিক দিক সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে স্থান দিয়েছেন, যা এক কথায় অনুপম। সুতরাং বিভূতি ভূষণ পথের পাঁচালী উপন্যাসের জন্য কিংবদন্তি এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীকে শিল্পরূপে উপস্থাপন করার জন্য কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন। মানবচরিত্রের জটিলতা বৈচিত্র্যময় হৃদয়বৃত্তি বিভূতি ভূষণ আঁকেননি। সহজ, সরল, গ্রামীণ ও অরণ্য মানুষের ছবি আঁকতেই তার টান। কর্মের দহনে জীবন সংগ্রামের সক্রিয় ভূমিকায় মানুষকে তিনি দেখেননি। সেখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই তাকে দেখেছেন। অবহেলিত মানুষের প্রতি তার ভালবাসা নিতান্তই আবেগপ্রসূত যুক্তিসিদ্ধ নয়। এখানেই তার সীমাবদ্ধতা।উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সবুজ আরণ্যানী পথ ও প্রান্তর এবং সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাপনের প্রকৃতি শুধুমাত্র বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং যেন চিত্ররূপ হয়ে পাঠকদের চোখের সামনে ধরা দিয়েছে।

এই মহান ঔপন্যাসিক বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ১৯৫০ খ্রিঃ ১ নবেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।


No comments:

Post a Comment